Breaking

Saturday, July 19, 2025

বাঙালির আবেগ, মন, মনন অনুশীলনে ব্যর্থ বিজেপি!

ছাব্বিশে আসন ছাব্বিশে নেমে আসবে না তো...? 


বিশেষ প্রতিবেদন, অনিকেত পান্থ 

       বিজেপির পরাজয় আসলে মোদির হার।  আর বিজেপির সাফল্য সকলের সমবেত প্রয়াসের ফসল।  বীজ, বীজতলা, জল, বায়ু, রোদ, ছায়া সবই দরকার অঙ্কুরিত বীজকে মহীরুহে পরিণত করতে। কিন্তু সেসবের কোনোটাই  বঙ্গ বিজেপির বেলায় যথাযথ  নয়। ফলে অতীতের মতো আগামীতেও  ফলন কতটা হবে তা এখনই বলে দেওয়া যায়।

      ছাব্বিশে কী হবে সেটা এরাজ্যের ভোটাররা বিলক্ষণ জানেন, বঙ্গ বিজেপির নেতারাও ভালো জানেন। তবুও তাঁরা ভোটারদের প্রভাবিত করতে মরিয়া। আসলে বাঙালির আবেগ অনুধাবনে এই গেরুয়া দলটি বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।  এই ব্যর্থতার দায় তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় না, আবার এজন্য দায়ী তারাই। কারণ বাংলা আর বাঙালির আবেগ পুথিগত জ্ঞান আর তত্ত্বকথা দিয়ে বোঝা ও ব্যাখ্যা করা যায় না। এসব হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। আর এখানেই চরম ব্যর্থ বঙ্গ বিজেপি তথা তাদের জাতীয় নেতারা।

       বঙ্গ বিজেপি কখনো ভুল করছে, কখনো তারা ভুল  ভাবছে আর কখনো-বা ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এগুলির কোনোটাই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষেত্রে সেভাবে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই রাজ্যে দলের কোনো অবিসংবাদিত নেতা বা বিশ্বাসযোগ্য কোনো মুখ নজরে পড়ে না। তাই বাংলায় এরা সরাসরি ভোটের তথা ভোটমুখী রাজনীতি করছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এটা অনেক আগেই  বুঝে গেছে। ফলে এত চেষ্টার পরও বিজেপি এরাজ্যে ক্ষমতায় আসতে পারছে না।

       ভোটের একবছর আগে থেকেই কার্যত  নির্বাচনি জনসভা শুরু করে দিয়েছে বিজেপি। আলিপুরদুয়ার, সল্টলেক  আর দুর্গাপুরের হিসেব  মেলালে স্পষ্ট বোঝা যায় যে  মোদি - শাহ  এবার " ডু  অর  ডাই " নীতি নিয়ে বাংলার ভোটযুদ্ধে নেমে পড়েছেন। তবু এবারও এই দলের জন্য কোনো বড়ো সাফল্য অপেক্ষা করে নেই। কেন নেই সেই প্রসঙ্গে আসি। বাংলায় এসে পাঁচ হাজার কোটির প্রকল্প ঘোষণা করছেন আর বাংলার এক লক্ষ সত্তর হাজার টাকা টাকা আটকে রেখেছেন। এরাজ্যের মানুষ এর একটা গতকাল, শুক্রবার জানলেন আর অন্যটা অনেক বছর ধরে জানেন।  আর বেঙ্গল প্যাকেজ নিয়ে এলেই যে সেসব বাস্তবতার মুখ দেখবে তার নিশ্চয়তা কোথায়...? 

       দেশের প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হঠাৎ এত বঙ্গপ্রেম কেন জাগল ? উত্তরটা সকলেই জানেন। শুধু  মুখ ফুটে বলার সাহস পান না। স্বাভাবিক। বাংলা আর বাঙালির সঙ্গে উনারা যা শুরু করেছেন...! পর্দার সামনে উনাদের বাঙালিপ্রীতি আর পর্দার অন্তরালে বাঙালি, বাংলাভাষী মানুষদের সঙ্গে এখন কী চলছে সেখান থেকে উত্তরটা সবাই পেয়ে যাবেন। ভোটের রাজনীতির কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ আর বাস্তবের আন্তরিক উন্নয়ন ---- এ দুইয়ে ফারাক ছিল, আছে, থাকবেও। আর এজন্যই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বারবার বাংলায় এসে বাঙালির  সামনে মাথা নোয়াতে হয়, করজোড়ে বলতে হয় যে একবার, মাত্র একবার বিজেপিকে বাংলায় ক্ষমতায় আনুন। এখান থেকে কি একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যায় না? যায়। সেটা ভোটের রাজনীতি।

      সত্যি সত্যি বাংলার উন্নয়ন চাইলে, বাংলার ভালো করার মানসিকতা থাকলে অনেক ভাবেই করা যায়। বাংলার ক্ষমতা দখল করতে পারলেই বাংলার মানুষের জন্য সব ভালো করবেন, এখানকার সব উন্নতি হবে ---- এই যুক্তি মানা যায় না। তাহলে তো দেশের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই অবস্থা, এই অব্যবস্থা হতো না। এককথায় বললে বাংলা দখল করতে পারলে দিল্লিতে ক্ষমতা ধরে রাখার পথটা অনেক মসৃণ হয়ে যাবে। বাংলার চেয়ে বেশি লোকসভার আসন উত্তরপ্রদেশে। আর লোকসভার গতবছরের নির্বাচন থেকে ভবিষ্যতে উত্তরপ্রদেশের হাল কী হবে সেই উত্তরটা বিজেপি পেয়ে গেছে। আগামী চার বছর পর উত্তরপ্রদেশে ভোটব্যাংক আর আসন দুইই কমবে। তাহলে এই ঘাটতি পূরণ কোথা থেকে হবে...? অবশ্যই "বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল" এই ঘাটতি মেটাবে।

        পরিবর্তন চাইতে চাইতে বিজেপি দলটা আর দলের নেতাদেরই পরিবর্তন হয়ে গেল। বাঙালির মন তাঁরা পেলেন না। এই যেমন আগে উনারা বলতেন, "জয় শ্রীরাম";  এখন বলছেন, "জয় মা কালী, জয় দুর্গা"। কেন হঠাৎ এই বোল বদল...! উত্তরটা স্পষ্ট। বিচক্ষণ, দরদি রাজনীতিবিদ আর বাঙালির নাড়ি টিপে মন আর মননের খবর নেওয়ার ক্ষমতা থাকায় অনেক আগেই ওই "জয় শ্রীরাম" - এর পাল্টা তিনি দিয়ে দিয়েছেন। বাংলা মূলত বৈষ্ণবভূমি। এখানে কৃষ্ণ, জগন্নাথ, গৌরাঙ্গ বা এই ধরনের বৈষ্ণব ধর্ম আর দর্শনের  জয়জয়কার বরাবর ছিল, আছে আর থাকবেও। আসলে বাংলায় ওই "জয় শ্রীরাম" রামনবমীতে চলে। সারাবছর ওটা খায় না।  আগেই বলেছি যে বাঙালি বৈষ্ণব দর্শনের অনুগামী, অনুরাগী। রাম তো বৈষ্ণব নন, তিনি তো ক্ষত্রিয়, তাই অবশ্যই শাক্ত। বরং গুজরাটের ওই "জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীকৃষ্ণ" এখানে ভালো খাবে। 

       এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো এটা খুব ভালো বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি জয় শ্রীরামের বদলে খুবই সুন্দর আর উপযুক্ত স্লোগান "জয় জগন্নাথ" নিয়ে এসেছেন। শুধু এরাজ্যের সাধারণ মানুষ নয়, বিজেপির বড়ো বড়ো মাথাও এই জয় জগন্নাথে মোহিত হয়ে পড়েছেন। নইলে কী দিলীপ ঘোষের মতো সর্বভারতীয় বিজেপি নেতা দিঘায় সস্ত্রীক ছুটে গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করে আসতেন...! বাকিরা সরাসরি সেখানে না গেলেও মানসদর্শন নিশ্চয়ই করেছেন। আর করাটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকুক। বাঙালির আবেগের জায়গাটায় রাজনীতিকে মেলাবেন না। পুরীতে এত দূরে আর একটা ভিন্ন পরিবেশে ছুটে গিয়ে এতদিন জগন্নাথ দর্শন করতে হতো বাংলা আর উত্তরপূর্ব ভারতের বাঙালিদের। এবার তাঁরা কাছেই পেয়ে গেলেন জগন্নাথকে। আর এই জগন্নাথ এবার তৃণমূলের জন্য সুফল বয়ে আনবেন। এই মন্দির ঘিরে ধর্মীয় আর সৈকত পর্যটনে নবজোয়ার আসবে। বিজেপি নেতারা তখন আড়াল থেকে সেসব দেখবেন।

     সবশেষে, বাংলাভাষী আর অনুপ্রবেশকারী ইস্যুতে দুচার কথা বলতেই হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারী ইস্যুতেও বিজেপি "সুপার ফ্লপ" । কারণ অনুপ্রবেশ ঘটে সীমান্ত দিয়ে আর সীমান্ত সুরক্ষায় চরম ব্যর্থ বিএসএফ অর্থাৎ অমিত শাহ। তাই এক্ষেত্রে কেন্দ্র আর বিজেপি দায়ী। আর ভিনরাজ্যে তথা বিজেপি শাসিত  রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষীদের ওপর অত্যাচার, পুলিশি জুলুম, তাদের আটক, বন্দি করে রাখার ঘটনা নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশও কেন্দ্রের বিজেপির বিরুদ্ধেই গেছে। কারণ দেশের নানা স্থান থেকে বাংলাভাষী মানুষদের ধরে নিয়ে এসে জল স্থল সমুদ্র আর আকাশপথে বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন একটি জ্বলন্ত আর বাঙালির আবেগ নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার দারুণ সুযোগ পেয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এযাত্রায়ও তিনি জয়ী হবেন। কারণ এমন একটি মানবিক ইস্যুতে অন্যভাবেও সমাধানের রাস্তায় হাঁটা যেত। আসলে পূর্ববাংলার ইউনূস আর পশ্চিমবাংলার মমতাকে একযোগে বেলাইন করার বিজেপির বেঙ্গললাইন নিজেই বেলাইন  হয়ে গেল।

       সবমিলিয়ে মোদি থেকে শাহ, যোগী থেকে হিমন্ত মমতার সামনে বাঙালির আবেগ নিয়ে রাজনীতি করতে এসে একের পর এক সুপার ফ্লপ শো উপহার দিচ্ছেন। আর এরপরও বঙ্গ বিজেপি নেতারা বলছেন ছাব্বিশে এরাজ্যে তাঁরা ১৭০টা আসন পাচ্ছেন। একুশে ২০০ আসন পার করার কথা বলে পেয়েছিলেন মাত্র ৭৭টি। সেই হিসেবে সংখ্যাটা এমনিতেই কমে যাচ্ছে। তারপর লোকসভার গতবছরের ভোট বলে দিয়েছে বঙ্গ বিজেপি কেমন অবস্থায় আছে। তা ছাড়া পুরোনো ইস্যুর সঙ্গে আছে জ্বলন্ত নয়া ইস্যুও। সব মিলিয়ে বাঙালির আবেগ, মন আর মনন বুঝতে চরম ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। আর এর ফল তারা ভালোই পাবে। তারপরও দলে বিভাজন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, স্বার্থ আর সংঘাত রয়েই গেছে। এত কিছুর পরও বাংলা দখল করতে চাইলে এবারে সংখ্যাটা খুব বেশি হলে ৪০ থেকে ৫০ হবে। আর ছাব্বিশে সংখ্যাটা ২৬ - এ নেমে এলেও হয়তো অবাক হবে না অনেকেই।



No comments:

Post a Comment