বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ
*** সাহিত্য জীবনবেদ। যেকোনো মহান সাহিত্য শাশ্বত মানবের কথা বলে। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা সাহিত্যও চিরমানবের জয়গানে মুখর। আর বাংলা সাহিত্যে জীবনের এই জয়গান সবচেয়ে বেশি গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
*** বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে বঙ্গপ্রকৃতি আর পল্লিগ্রামের মানুষের কথা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ জীবনপ্রবাহের একটা বড়ো অংশ কাটিয়েছেন গ্রামবাংলায়। ভরা বর্ষায় পদ্মার বুকে তিনি ভেসে বেড়িয়েছেন। পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনার কাজে পতিসর, সাজাদপুর, শিলাইদহে তিনি জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। সেই সূত্রে রবিঠাকুর বাংলার পল্লিপ্রকৃতি, প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা জীবন, এখানকার মানুষ, তাদের জীবনের হাসিকান্না, আনন্দ - বেদনা, চাওয়া - পাওয়া ইত্যাদিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আর রবীন্দ্রসাহিত্যে এসবই সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছে। তাঁর কবিতায়, গানে, ছোটোগল্পে নিজের চোখে দেখা এই জীবনটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এসবই তাঁর সাহিত্য আর সৃষ্টিকে চিরকালের মহান শিল্পের মর্যাদা দিয়েছে।
*** রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি। তবে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এজন্য তাঁর লেখা ছড়া, গান, গল্প, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, লোকসাহিত্য, লোকসংগীত ইত্যাদিও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি জীবনভর মানুষের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি চিরকালীন। তিনি বঙ্গপ্রকৃতির রূপের সাথে বিশ্বপ্রকৃতিকে মিশিয়েছেন। এজন্য তাঁর সাহিত্য চিরকালের মানুষের কথা তথা বিশ্বমানবের কথা বলেছে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য কল্পনা করা যায় না। যুগে যুগে অনেক কবি, লেখক, গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক বাংলা সাহিত্যে এসেছেন, ভবিষ্যতেও অনেক সাহিত্য রচিত হবে। কিন্তু রবিঠাকুর বাংলা সাহিত্যে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। তাঁকে বাদ দিয়ে বাঙালির জীবন আর সাহিত্য হলে সেখানে অনেক মহান আদর্শ, শাশ্বত জীবনদর্শন, মহামানবের কথা বাদ পড়ে যাবে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান আর তাঁর স্থান ঠিক এইরকমই।
*** রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জীবনের রূপকার। তিনি বাঙালির শেষ আশ্রয়। বাঙালি তাঁকে আশ্রয় করেই বাঁচে। বাঙালি জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ নেই। রবীন্দ্রসাহিত্য মানুষকে অনেক দুর্দিনে, দুঃসময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা জুগিয়েছে। বাঙালির আবেগ, উচ্ছ্বাস, বাঙালির স্বপ্ন, বাঙালির আকাঙ্ক্ষা, বাঙালির বিশ্বভুবনে উড়ান রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। এজন্য বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে, তাঁর জন্মদিন, তাঁর মৃত্যুদিন পালন করতে ঠিক যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করে। কেন-না এসব ক্ষেত্রে আমরা অন্য কোনো কিছুর আশ্রয় না নিয়ে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের নানা সৃষ্টিতেই তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে পারি, তাঁকে স্মরণ করতে পারি। অর্থাৎ তাঁর গান, তাঁর কবিতা, তাঁরই নাটক, তাঁর নৃত্যকলা, তাঁর চিরকালীন বাণী ইত্যাদি দিয়েই আমরা তাঁকে স্মরণ, বরণ, শ্রদ্ধা জানাতে পারি। আমরা তাঁর ভাষাতেই কথা বলি, তাঁর সুরে গান গাই, তাঁর জীবনদর্শন, শিক্ষদর্শন আমাদের সারাজীবনের পাথেয়।
*** তিনি পূর্ববাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে শুধু যে সাহিত্য রচনা করেছেন তা নয়। তাদের সুখে - দুঃখে, জীবনে - মরণে, স্বপ্ন - আকাঙ্ক্ষায় তিনি বাস্তবেই পাশে থেকেছেন। এই কাজটা তিনি বাস্তব জীবনে যেমন করেছেন, তেমনি সাহিত্যকর্মেও এমন পথনির্দেশ করে গেছেন। এজন্যই বাঙালির শেষ আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই বলতে পারি, বাঙালি যদি রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে তার সাহিত্য, তার জীবন, তার পরিচয়ের কথা ভাবে, যদি তারা সংকীর্ণ চিন্তাধারার আশ্রয় নেয়, তাহলে সেটা হবে রবীন্দ্রসাহিত্য আর তাঁকেই অবমাননা। কেন-না তাঁর সাহিত্যে, শিল্পে, সৃষ্টিতে কোত্থাও, কখনো সংকীর্ণতা, বিচ্ছিন্নতা, ভাগাভাগি, হানাহানির স্থান নেই। আজ বাঙালি যে হানাহানি, ভাগাভাগি, অবক্ষয় আর সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনায় মেতেছে, সেখানে রবীন্দ্র জীবনদর্শন, রবীন্দ্রভাবনা, তাঁর শিক্ষাদর্শন মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশ তো তিনি রেখে যাননি। তিনি এখানকার মানুষকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছেন , তাদের ভালোবাসার বাঁধনে তিনি বেঁধেছিলেন। এই বাঁধন ছিঁড়ে গেলে সেটা বাঙালি জাতির জন্যই দুর্দিন, দুঃসময় নিয়ে আসবে। আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি থেকে বরাবর এই শিক্ষাই পেয়েছি। তাঁর জীবনদর্শনও আমাদের এটাই শিখিয়েছে। আমরা সেই শাশ্বত মানবের বাণী ভুলে গেছি, ভুলে গেছি সেই সুন্দর জীবনদর্শন। এজন্যই আজকের দিনে এসে রবিঠাকুর আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
*** আমাদের ছোটোনদী আর আমার সোনার বাংলা দিয়ে খুব ছোটোবেলায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। এরপর প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি আর বৃহত্তর জীবনপ্রবাহে আমরা কখনোই রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে থাকতে পারি না। আর এই সাথে থাকা, পাশে থাকা অবশ্যই তাঁর রচিত সাহিত্যকর্মের মাধ্যমেই। তাঁর হাজার হাজার কবিতা, শতাধিক ছোটোগল্প , অগণিত গল্প ও প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস আর অবশ্যই রবীন্দ্রসংগীত যুগে যুগে বাঙালিকে প্রেরণা জোগাবে। রবিঠাকুর রচিত বাংলা সাহিত্য আর রবীন্দ্রসংগীত থেকে বাঙালি যে প্রেরণা পায় তা তাকে বিশ্বমানবের সারিতে উত্তরণের পথ দেখায়। তাই বাংলা সাহিত্যে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে তিনি চির অম্লান হয়ে থাকবেন। বাংলা সাহিত্যের চিরকালের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ।
( #কবিগুরুর_প্রয়াণ_দিবসে_শ্রদ্ধাঞ্জলি )
#Rabindranath_Tagore_In_Bengali_Literature
©@--- মৃণাল কান্তি দাস (সুমন)
No comments:
Post a Comment