'এক সারিতে' ফরাসি বিপ্লব আর জুলাই অভ্যুত্থান!
বাস্তিল দুর্গের পতনের সঙ্গে গণভবন দখলকে "মেলালেন" ফরাসি রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুই
বিশেষ প্রতিবেদন, অনিকেত পান্থ
এমন তুলনা কি হওয়া উচিত ? এই তুলনা কি মহান ফরাসি বিপ্লবকে খাটো করে দেখাচ্ছে না ? শুরুতেই প্রশ্ন তুললাম। আর এই প্রশ্ন মনে জাগলো বলেই এমন বিতর্কিত একটি বিষয়ে লিখতে শুরু করলাম। এমন তুলনা বাংলাদেশের দখলদারদের কেউ করেননি। তুলনা টেনেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুই। এজন্যই বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়েছে বলে আমি মনে করি।
১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব বিশ্বের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ঘটনা। রাজতন্ত্রের বিলাস - বৈভবের সঙ্গে সাধারণ মানুষের অতিসাধারণ চাওয়া - পাওয়ার কী পরিমাণ ফারাক ছিল ফরাসি বিপ্লব চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের তা দেখিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সমতাবোধ আর মানবমুক্তির সুমহান আদর্শকে সামনে রেখে ফরাসি বিপ্লবের নেপথ্যে শক্তি জুগিয়েছিলেন ফ্রান্সের দার্শনিকরা। শেষপর্যন্ত অপশাসন আর শোষণের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্যে দিয়ে ফরাসি বিপ্লব জয়যুক্ত হয়।
ঢাকায় গত বছরের জুলাই মাসের শুরু থেকে "লোকদেখানো" কোটাবিরোধী আন্দোলনের ধুয়ো তুলে কিছু ছাত্র নামধারী "ধান্দাবাজ" দেশিবিদেশি শক্তি আর অপশক্তির "মদতে" সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল। আসলে এর নেপথ্যে ছিল বিশ্বের বড়দার "বিশেষ স্বার্থরক্ষায়" শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো। তারা এই লক্ষ্যে সফল হওয়ার জন্য আন্দোলনকারী এই বিক্ষুব্ধ জনতাকে সবরকম সহযোগিতা এমনকি "অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ, বারবার বৈঠক" ইত্যাদি উপায়ে "সমর্থন" জুগিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল।
পরবর্তীকালে মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষস্তর থেকে আসা বিবৃতি থেকে সারাবিশ্বের মানুষ এসম্পর্কে শুনেছেন, দেখেছেন, পড়েছেন। বাংলাদেশের এই প্রজন্মের আন্দোলনকারী দিশাহীন ছেলেমেয়ের দলও সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করেছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য কী ছিল সেকথা। খোদ মুহাম্মদ ইউনূসও মার্কিন মুলুকে এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড মাহফুজ আলমকে বিশ্বের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আর ৮ আগস্ট যে উপদেষ্টা পরিষদ দেশ পরিচালনা করার জন্য শপথগ্রহণ করেছে তার সদস্যদের প্রায় সকলেই হলেন বিদেশি নাগরিক।
আরও স্পষ্ট করে বললে তাঁরা বাংলাদেশের মানুষ হলেও বহুবছর ধরে তাঁদের সঙ্গে দেশের মাটি আর মানুষের কোনো যোগাযোগ নেই। তাঁরা এখন ইউরোপ আর আমেরিকার নাগরিক। আর তাঁরা দেশ পরিচালনায় যে পুরোপুরি "ব্যর্থ" আর এই ব্যর্থতা যে "পাহাড়প্রমাণ" সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয়েছিল যে বাংলাদেশে গত জুলাই মাসের বিক্ষোভ আর আন্দোলন ছিল শেখ হাসিনার সরকার ফেলার পূর্বপরিকল্পিত একটা "ষড়যন্ত্র"। এর সঙ্গে কোনোভাবেই মহান ফরাসি বিপ্লবের তুলনা হতে পারে না। তবু ফরাসি রাষ্ট্রদূতের এই তুলনা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে ফ্রান্সের ভিত আরও শক্ত করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আমি মনে করি।
যাই হোক, এবার ঢাকায় নিযুক্ত ওই ফরাসি রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুই - এর বিবৃতি বা তুলনা প্রসঙ্গে ফেরা যাক। রবিবার রাতে ঢাকায় "ফ্রান্স ন্যাশনাল ডে" উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, "....যে মূল্যবোধের জন্য আপনারা লড়াই করেছেন তা আমাদের কাছে খুব পরিচিত।" তিনি আরও বলেন, "আপনারা জানেন যে আজ থেকে ২৩৬ বছর আগে ফ্রান্সের জনগণ রাজনৈতিক বন্দিশিবির আর রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ দখল করেছিল। বাস্তিল দুর্গের এই পতনের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেটাই পরবর্তী সময়ে ফরাসি বিপ্লব হিসেবে পরিচিতি পায়।"
এই বক্তব্যের মাধ্যমে ফরাসি রাষ্ট্রদূত আসলে গণভবন দখলকে বাস্তিল দুর্গ দখলের সঙ্গে "মিলিয়েছেন"। অর্থাৎ তিনি এই দুই অসম ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনাকে "একই সারিতে" নিয়ে এলেন মানে দুই ঘটনাকে একসঙ্গে "মেলালেন"। বাস্তবতার দিক থেকে এই তুলনা শুধু "হাস্যকরই" নয়, প্রকৃত রাজনৈতিক জ্ঞানের "শূন্যতাকে" প্রকট করেছে। তাঁর মতে, ঘৃণিত শাসনের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনের দখল নিয়েছিল। এরও প্রায় একবছর হয়ে এলো। এবার দেশজুড়ে ৫ আগস্ট অর্থাৎ গণভবন দখলের দিনটি পালিত হবে। প্রসঙ্গত, গণভবন দখলের পর যে লুটতরাজ আর পৈশাচিক উল্লাসে সেদিন উন্মত্ত জনতা মেতে উঠেছিল, সেই প্রসঙ্গে মেরি কোনো বাক্যব্যয় বা নিন্দাসূচক কিছুই উচ্চারণ করেননি।
ফরাসি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য এখানেই থেমে থাকেনি। তিনি আরও বলেছেন, "গণতন্ত্র হচ্ছে স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও অন্তর্ভুক্তি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার অধিকার এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের কঠিন পথে উত্তরণের অন্যতম ভিত্তি। আর অবশ্যই এর সঙ্গে ন্যায়বিচার থাকবে। তবে গণতন্ত্রের এই উত্তরণ এত সহজ নয়। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের গণতন্ত্র সুসংহত করতে একশো বছর সময় লেগেছিল। আমার বিশ্বাস, আপনারা অনেক কম সময়ে এই কাজে সফল হবেন।" প্রসঙ্গত, তিনি যেসব মহান আদর্শের কথা বললেন গত এগারো মাসে বাংলাদেশে এর বিপরীত ছবি দেখা গেছে। এইসময় বাংলাদেশ একটি চরম অরাজকতার দেশে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রশংসা করে তিনি বলেন, "প্রধান উপদেষ্টার অসাধারণ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সত্যিকারের গণতন্ত্রের দিকে এগুচ্ছে। এই পথে বাধা অনেক। ধৈর্য, সংকল্প আর সাহসের মধ্য দিয়ে এই বাধাগুলি দূর করতে হবে।" প্রসঙ্গত, ফ্রান্সের সহযোগিতায় বাংলাদেশে নানা প্রকল্প চলছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকায় বিশুদ্ধ ও মানসম্পন্ন জলসরবরাহ, চট্টগ্রামে নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি। গত ১০ বছর ধরে ফ্রান্স বাংলাদেশে নানা প্রকল্পে হাত দিয়েছে। সেদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতীয় নানা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে স্রেফ ভারতবিরোধিতার নামে। ফরাসি প্রকল্পগুলি যাতে ভালোয় ভালোয় উতরে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ রেখেই হয়তো ফ্রান্সের এই রাষ্ট্রদূত নানা প্রশংসাসূচক কথা বলেছেন। তবে তাঁর বক্তব্যে যে অতিশয়োক্তি ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই।
No comments:
Post a Comment